গরু মোটাতাজাকরনে দেয়া হচ্ছে হরমোন বা স্টেরয়েড,যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অবৈধভাবে গরু মোটাকরার ওষুধের চোরাচালান বাড়ছে
আলোরকোল ডেস্ক ।।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অবৈধভাবে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য ব্যবহৃত ওষুধের চোরাচালান বাড়ছে। বিজিবি হিলির মংলা বিওপি ক্যাম্প কমান্ডার নায়েব সুবেদার মো. শাহজাহান একথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি হিলি সীমান্তের ঘাসুড়িয়া এলাকা থেকে দুই বস্তা ভর্তি ২৯ হাজার ৮৫০ পিস গরু মোটা করার ট্যাবলেট উদ্ধারের পর তিনি এমন তথ্য জানান।
শাহজাহান বলেন, ‘মাঝে মাঝে এ ধরনের চালান আসে। সামনে কোরবানির ঈদ। এ উপলক্ষে মানুষ গরু মোটাতাজা করছে। এজন্য এখন এ ধরনের চালানের চাপ একটু বাড়বে। ঈদের আগ পর্যন্ত।’
এ ধরনের চোরাচালান প্রতিরোধ করার জন্য বিজিবির নিয়মিত সদস্যদের সতর্ক টহল থাকে জানিয়ে বিজিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, ঈদে চাপ বাড়ার কারণে পাঁচ সদস্যের বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। এদের দায়িত্বই হচ্ছে এ ধরনের চোরাচালান প্রতিরোধ করা।
কত দিনে কাজ করে এসব ওষুধ?
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ডা. এ কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, প্রাণীদেহে স্টেরয়েড বা ওষুধের কার্যকারিতা শুরু হতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে এসব ওষুধ ছাড়া বৈজ্ঞানিক উপায়ে গরু মোটাতাজা করতে হলে কমপক্ষে ৯০ থেকে ১২০ দিন আগে থেকে গরুর লালন-পালন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।
এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে গরুর খাদ্যাভ্যাসে। এর ফলে খর এবং দানাদার খাদ্য দিতে হবে। তবে আমাদের দেশের খরে পুষ্টিগুণ কম থাকায় এগুলোতে প্রক্রিয়াজাত করে গরুকে খাওয়াতে হবে। যাতে ব্যবহার করা যেতে পারে চিটাগুড় এবং পরিমিত মাত্রায় ও সঠিক পরিমাণে ইউরিয়া। তবে ইউরিয়া সরাসরি খাওয়ানো যাবে না।
বাংলাদেশে ফিনিশিং কর্মসূচিরর মাধ্যমে গরু মোটাতাজাকরণ করা হয়। তার মধ্যে দুটি ভাগ আছে। একটি রেগুলার, অন্যটি সিজনাল। এর মধ্যে সিজনাল অর্থাৎ ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণের প্রবণতা বেশি। তবে এর জন্য কমপক্ষে ৩ মাস আগে থেকে প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এক মাসে স্টেরয়েড ব্যবহার করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে সে বেশি পরিমাণে স্টেরয়েড ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে। এটা পশুর জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ওই পশুর মাংস যারা খায় তাদের জন্যও ক্ষতিকর।
পশুকে স্টেরয়েড বা হরমোন প্রয়োগ করা হলে তা পশুর প্রস্রাব বন্ধ করে দেয়। ফলে পশুর চামড়ার নিচে পানি জমতে থাকে এবং তা ফুলে যাওয়ায় পশু স্বাস্থ্যবান দেখায়। তবে এসব ওষুধ প্রয়োগ বন্ধ করা হলে, পশু আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।
কিভাবে চেনা যাবে হরমোন ব্যবহার করে মোটাতাজা করা গরু?
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, একটা গরুর চামড়ায় যদি আঙুল দিয়ে চাপ দেওয়ার পর যদি আঙুলের ছাপ লেগে থাকে, চামড়ার নিচে যদি পানি জমে তাহলে সহসা চামড়াটা আগের অবস্থায় ফিরে আসে না, তাহলে বুঝতে হবে যে গরুটিকে মোটাতাজা করতে অবৈধ উপায়ে হরমোন বা ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে।
অন্যদিকে যদি সুস্থ সবল গরু হয় তাহলে চাপ দিলে সঙ্গে সঙ্গে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের গরুর চাহনি ড্রাউজি বা ঘুমন্ত হবে। চোখ দেখলে মনে হবে গরুটা ঘুমিয়ে যাচ্ছে। চোখের চাহনি চঞ্চল বা পরিষ্কার হবে না।’
এ ছাড়া গরুটি খুব ক্লান্ত মনে হবে। সুস্থ গরু চঞ্চল হয়, নড়াচড়া করে। কিন্তু স্টেরয়েড বা হরমোন দেয়া গরুর তেমন নড়াচড়া করবে না। প্রস্রাব ব্যথায় শুয়ে থাকবে।
এসব বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পশুরোগ অনুসন্ধানাগারে গরুর রক্ত পরীক্ষা করে জানা সম্ভব যে হরমোন বা স্টেরয়েড দেওয়া হয়েছে কিনা।
ঈদে অবৈধভাবে মোটাতাজাকরণ ঠেকাতে কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নোটিশ জারি ও টিম গঠন করে খামারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে খামারিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে এ ধরনের ওষুধের ব্যবহারে ঠেকানো হয়।
এসব নির্দেশনা কোনো খামারি না মানলে তার বিরুদ্ধে মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা ও জরিমানা করা হয়। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সব খামারকে নিবন্ধন করা হয়।
কোরবানির আগে সারা দেশ ব্যাপী ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। যাদের দায়িত্ব, ঈদের তিন দিন আগে থেকেই গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং কোনো প্রকার অবৈধভাবে গরু মোটাতাজা করছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এই টিমগুলো কোরবানির হাটেও কাজ করবে।
মৎস্য খাদ্য পশু খাদ্য আইন ধারা ১৪তে বলা হয়েছে, গবাদি পশুর হৃষ্টপুষ্ট করণে কোনো প্রকার হরমোন স্টেরয়েড এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক জানান, বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ট্যাবলেট তৈরি এবং আমদানি কোনোটাই হয় না।তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশের কোনো পশু বর্তমানে স্টেরয়েড বা ওষুধ ব্যবহার করে মোটাতাজাকরণ করা হয় না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক বলেন, ‘গত তিন বছর ধরে, বিজিবি, পুলিশ এবং প্রাণীসম্পদ বিভাগের যৌথ উদ্যোগে নজরদারি চলছে। যার কারণে মার্কেটে স্টেরয়েড দেওয়া গরুর অস্তিত্ব তারা খুঁজে পাননি তারা।’
এ ধরনের গরুর মাংস কতটা নিরাপদ?
গরু মোটাতাজা করণে হরমোন বা স্টেরয়েড ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি চিকিৎসার কারণেও গরুকে হরমোন বা স্টেরয়েড দেওয়া হয় তাহলেও এর জন্য নির্ধারিত সময় পার করেই ওই গরু বাজারে তোলা উচিত।
এ ব্যাপারে খালেদুজ্জামান বলেন, কিছু কিছু হরমোন বা স্টেরয়েড আছে যেগুলো খাওয়ানোর পর তার উইথড্রয়াল পিরিয়ড আছে। যা সাধারণত ৫-৬ দিন হয়। এই নির্ধারিত সময় পার করেই পশুকে বাজারে নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে স্টেরয়েড বা হরমোন সমৃদ্ধ মাংস খেলে মানব দেহে পেটের বিভিন্ন অসুখ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদী কিডনি জটিলতা এমনকি ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।