প্রধান মেনু

হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখি

এম.পলাশ শরীফ  ।।

কবি রজনীকান্ত সেনের লেখা ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,/ কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে। ’— অমর এক কবিতার লাইনগুলো নিশ্চয়ই আজো সবার মনে আছে। পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকা কবিতাটি পড়ে শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখি ও বাবুই পাখির শিল্পনিপুণতার কথা জানতে পারলেও মানুষের অসচেতনতায় আজ বাবুই পাখি ও এদের বাসার অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে বাবুই পাখি।

এরা খুব সুন্দর বাসা বোনে বলে ‘তাঁতি পাখি’ নামেও পরিচিত। এদের বাসার গঠন বেশ জটিল হলেও আকৃতি খুব সুন্দর। কয়েক প্রজাতির বাবুই একাধিক কক্ষবিশিষ্ট বাসা তৈরি করতে পারে। তুতির সঙ্গে এরা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এরা মূলত বীজভোজী পাখি। এদের ঠোঁটের আকৃতি বীজ ভক্ষণের উপযোগী; চোঙাকার আর গোড়ায় মোটা।

রাতে বাসায় আলো জ্বালার জন্য বাবুই পাখি জোনাকি পোকা ধরে এনে বাসায় গোঁজে এবং সকাল হলে জোনাকি পোকাদের আবার ছেড়েও দেয়। বাবুই পাখির বাসা দেখতে একদম উল্টানো কলসির মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই পাখি খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয় ঘাসের আস্তরণ সারায়। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘষে (পালিশ করে) গোল অবয়ব মসৃণ করে। এদের তৈরি খড়কুটোর বাসা দেখতে বেশ আকর্ষণীয় ও মজবুত হয় এবং প্রবল ঝড়েও তা পড়ে না।

বাবুই পাখির শক্ত বুননের বাসা শিল্পের অনন্য সৃষ্টি, যা একজন মানুষের কাছে সহজে টেনে ছেঁড়া সম্ভব না। বাসা তৈরির শুরুতে বাসায় দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকলেও পরে একদিক বন্ধ করে বাবুই পাখিরা তাতে ডিম রাখার জায়গা তৈরি করে। অপর দিকটি লম্বা করে তৈরি করে প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ।

বাবুই পাখি বাসা তৈরি করার পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে পুরুষ বাবুই পাখি স্ত্রী বাবুই পাখিকে সাথী বানানোর জন্য ভাব-ভালোবাসা নিবেদন করে এবং বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হতেই স্ত্রী বাবুইকে কাঙ্ক্ষিত বাসা দেখায়। কারণ বাসা পছন্দ হলেই কেবল এদের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। স্

ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুই পাখির সময় লাগে মাত্র চার থেকে পাঁচদিন। পুরুষ বাবুই পাখি এক মৌসুমে ৫-৬টি বাসা তৈরি করতে পারে। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণায় পুরুষ বাবুই পাখি মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীন বাসা তৈরির কাজ শেষ করে। তবে প্রেমিক বাবুই পাখি যতই ভাব-ভালোবাসা প্রকাশ করুক না কেন, প্রেমিকা বাবুই পাখির ডিম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রেমিক বাবুই পাখি আবার খুঁজতে থাকে অন্য সঙ্গী।

দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জনপদেই প্রায় বিলুপ্তির পথে প্রকৃতির বয়নশিল্পী বাবুই পাখি ও এদের বাসা। আগের মতো এখন আর প্রকৃতিপ্রেমীদেরও চোখে পড়ে না বাবুই পাখি, চোখে পড়ে না বাবুই পাখির তৈরি দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট বাসা ও বাসা তৈরির নয়নাভিরাম নৈসর্গিক দৃশ্য।

একসময় গ্রামাঞ্চলে সারি সারি উঁচু তাল, খেজুর ও নারকেল গাছের পাতার সঙ্গে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেত। কালের বিবর্তনে এখন তা আর সচরাচর চোখে পড়ে না। বর্তমানে যেমন তালগাছসহ বিভিন্ন গাছ নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে বাবুই পাখিও।

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলা দৃষ্টিনন্দন বাবুই পাখি ও তাদের নিজের তৈরি বাসা আজ বিলুপ্তপ্রায়। এ ছাড়া অনেক অসচেতন মানুষ এদের বাসা ভেঙে ফেলে আর এ কারণেও এদের সংখ্যা রহস্যজনকভাবে কমে গেছে। একশ্রেণির মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে ধনীদের কাছে বিক্রি করছে। এই বাবুই পাখির বাসা শোভা পাচ্ছে ধনীদের ড্রইং রুমে। বাবুই পাখির এ শৈল্পিক নিদর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*