যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু দন্ডিত আসামী আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার মারা গেছেন
মঠবাড়িয়া প্রতিনিধি :
পিরোজপুর-৩ মঠবাড়িয়া আসনের জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সাবেক সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু দন্ডিত আসামী আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার (৯০) পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন। আমেরিকার ফ্লোরিডায় চিকিৎসাধিন অবস্থায় মঙ্গলবার ভোরে তার মেয়ে বাসায় মৃত্যুর বিষয়টি তার পারিবারিক সূত্র স্থানীয় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় আমেরিকায় তার বড় মেয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।
আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ১৯৭১ সালে মঠবাড়িয়ায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে বিশাল এক রাজাকাকার বাহিনী গড়ে তুলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তিগামী মানুষের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালানোর অভিযোগে ২০১৪ সালের যুদ্ধাপরাধের মামলায় তিনি আমৃত্যু দন্ডিত হন। ওই মামলা দায়েরের আগেই তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে গত দশ বছর ধরে তিনি পলাতক অবস্থায় ছিলেন।
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩৬জন মুক্তিকামী মানুয়ের ওপর গণহত্যা, ৫৫৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ২০০জনকে জোরপূর¦ক ধর্মান্তরিত করাসহ ৫টি গুরুতর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে রয়েছে। এছাড়াও তিনি সেক্টর কমান্ডারস ঘোষিত ৫০ যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় জব্বার ইঞ্জিনিয়ার এর নাম রয়েছে।
জানাযায়, সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল জব্বারের উপজেলার টিকিকটা ইউনিয়নের সূর্যমণি গ্রামের ২৪ হিন্দু বাঙালীকে গণহত্যার দায়ে গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত জ্ঞানেন্দ্র মিত্র (৬২) বাদী হয়ে মঠবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মামলাটি দায়ের করেছিলেন। মামলায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও পিরোজপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাতীয়পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামী করে সাত জনকে আসামী করা হয়। এছাড়া মামলায় আরও ৬০/৬৫ জনকে অজ্ঞাত নামা আসামী করা হয়। ওই বছর ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে মামলা স্থানান্তরিত হয়।
পরে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধি পাঁচ ধরনের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১ মে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ওই বছর ১২ মে জব্বারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তবে এর আগে ২০১০ সালে তিনি গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আমেরিকায় আত্মগোপন করেন। ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি বিচারপতি এনায়েতুর রহীম এর নেতৃত্বাধিন গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১ এর আদালতে পলাতক যুদ্ধাপরাধি আব্দুল জব্বারের আমৃত্যু কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্রে জানাগেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় পর্টি (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে মঠবাড়িয়ায় গড়ে উঠেছিল রাজাকার বাহিনী। সূর্যমণি গণহত্যা, ভীমনলী গ্রামের বাড়ই বাড়ি গণহত্যা ও মঠবাড়িয়ার আটজন মেধাবী ছাত্র হত্যাসহ ফুলঝুড়ি গ্রামে অগ্নিসংযোগ লুটপাট আর অসংখ্য হিন্দু বাঙালীকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করার মত অপরাধে তিনি অভিযুক্ত।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তিনি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একবার এরশাদ সরকার ও একবার বিএনপির আমলে পিরোজপুর-৩ আসনের দুইবার সংসদ নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮৬ সালে তিনি ভোট ডাকাতির দায়ে এলাকার মানুষের কাছে বিতর্কিত হন। তার ভোট ডাকাতির প্রতিবাদের বিÿুব্দ জনতা সেদিন ÿোভে উত্তাল হলে আইন শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে চার জন নিহত হন।
১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে পিরোজপুর-৩ আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন।
৭৫ পরবর্তী তার রাজনৈতিক কর্মকাÐ শুরু হলেও এরশাদ আমলে মূলত তার রাজনৈতিক আবির্ভাব ঘটে। এরপর তিনি এরশাদের আস্থাভাজন হিসেবে জাতীয় পাটির্ (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। পরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও তিনি বিএনপিতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি।
উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের বলেশ্বর নদ তীরবর্তী ÿেতাছিড়ায় গ্রামের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এলাকায় সহস্রাধিক আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। এলাকায় হিন্দুদের ঘর বাড়ি লুটতরাজ, গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালায়।
আদালতের তৎকালীন বিচারিক হাকিম মো. কবির উদ্দিন প্রামানিক মামলাটি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ (৩) ধারায় তদন্ত পূর্ববক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মঠবাড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। পরে পুলিশ মামলাটি মানবতা বিরোধি অপরাধের বিচারের লÿে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভূক্ত করতে সুপারীশ করে। এ কারনে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল এ মামলার চারদফা তদন্ত সম্পন্ন করে।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় শান্তি কমিটির (পিচ কমিটি অব পাকি¯Íান) চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ইসকান্দার মৃধার নেতৃত্বে একদল রাজাকার বাহিনী দু’টি গণহত্যাসহ ৮ মেধাবী ছাত্র হত্যা, হিন্দু বাড়ীতে লুটপাট, নারী নির্যাতন ও অগ্নি সংযোগ করে।
জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী নেতৃত্বে ৬০/৬৫ জনের একটি রাজাকার বাহিনী ৭১’এর ৬ অক্টোবর রাত ১১ টার দিকে উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামে তাদের বাড়িতে হানা দেয়। এসময় তারা ৩০জনকে ধরে নিয়ে যায়। এসময় মামলার বাদীর বাবা জিতেন্দ্র নাথ মিত্র ও বড়ভাই (মামলার বাদি) জ্ঞান্দ্রে মিত্রকে ধরে নেওয়া হয়। এরপর ৩০জনকে সূর্যমণি বেড়ি বাঁধের পাড়ে নিয়ে গুলি করে রাজাকার বাহিনী। সেদিন ২৪জন শহীদ হন। বাদীর বাবা জিতেন্দ্র নাথ শহীদ হন তবে ভাই জ্ঞানেন্দ্র নাথ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যান।
সেদিন শহীদ হন জিতেন্দ্র মিত্র, সুরেন্দ্র মিত্র, মুকুন্দ মিত্র, ফনিভূষন, পরিমল মিত্র, অরুন মিত্র, শৈলান মিত্র, ঝন্টু মিত্র, নিহার মিত্র, সুধীর মাস্টার, সুধাংশু হালদার, বিরাংশু হালদার, মধুসূদন, প্রিনাথ, অন্যধা হালদার, অনীল হালদার, নগেন কির্ত্তনিয়া, সত্যেন্দ্র রায়, হরেন মাঝি, হিমান্ত হালদার, সিতানাথ হালদার, জিতেন মৃধা, নিহার মিত্র, জিতেন মাঝিসহ ২৪ জন।
তিনি ÿোভের সঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আজও এসব পরিবার কোন স্বীকৃতি পায়নি।
এ মামলার বাদি জ্ঞানেন্দ্র মিত্র গণহত্যার বিচার দাবি করে মামলা দায়েরের পর হত্যাশায় ও বিনা চিকিৎসায় ২০১২ সালে মারা যান।
উলেøখ্য ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালে আমৃত্যু কারাদন্ড রায় ঘোষণার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মঠবাড়িয়া শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে যুদ্ধাপরাধি জব্বারের ফাঁসির দাবি জানিয়েছিলেন।