প্রধান মেনু

প্রায় ৫৫০ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে

মিল্কভিটার জমি ভূমিদস্যুদের দখলে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে গোচারন ভূমি

শফিউল আযম, পাবনা থেকে।।
সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটার গোচারন ভূমি বাথানের প্রায় ৫৫০ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে। মিল্কভিটার বাথান কমিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ তদারকির অভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা এই জমি নিজেদের নামে জাল দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে জোরপূর্বক ভোগদখল করছে। এতে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে উত্তরের বৃহত্তম গোচারন ভূমি বাথান।

অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও শাহজাদপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) বাদী হয়ে আদালতে পৃথক ৬টি মামলা দায়ের করেছেন।
বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এক অর্ডিনেন্স বলে পাবনা জেলার সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাথান হিসেবে পরিচিত সমর্পিত খাস ও অর্পিত প্রায় এক হাজার ৮০০ একর জমি সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার নামে এককালীন লীজ প্রদান করেন। সেই থেকে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতিগুলো মিল্কভিটা থেকে বাৎসরিক লীজ নিয়ে রাউতরা বাথানের জমি গোচারন ভূমি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কিছু কিছু সমিতির স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তৎসময়ে মিল্কভিটা ও ভূমি অফিসে কর্মরত কিছু কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে জমির ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে জোরপূর্বক ভোগদখল করে আসছে। আবার অনেকেই বাথানের জমি গোচারন ভূমি হিসেবে লীজ নিয়ে ঘাস চাষ না করে ইরি-বোরো ধানের আবাদ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে চলনবিল অঞ্চলের সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার একর জমি গোচারন ভূমি ছিল্। জাল দলিল ও ভূয়া পত্তনি নিয়ে এলাকার একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি গোচারন ভূমি জোড়পূর্বক নিজেদের দখলে নিয়েছে। শাহজাদপুর উপজেলা ভুমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বাথান এলাকায় গোচারন ভূমির পরিমান কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার ৪০০ একর। এরমধ্যে ফরিদপুর উপজেলায় প্রায় ১০০ একর খাস, শাহজাদপুর উপজেলায় সমর্পিত খাস ৭১২ দশমিক ৬৮একর ও অর্পিত ৫৭৯ দশমিক ১৬ একর গোচারণ ভূমি রয়েছে।

মিল্কভিটার ম্যানেজার সমিতি জানান, বর্তমানে মাত্র ৮৫০ একর জমি তাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। অবশিষ্ঠ ৫৫০ একর ( এক হাজার ৬৫০ বিঘা) জমি ভূয়া দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বাথানের জমি দখল করে নিয়েছে। সরকারি এই জমি অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে উদ্ধারের জন্য আদালতে ছয়টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
অবৈধ দখলের কবলে পড়ে উত্তরের বৃহত্তম গোচারন ভূমি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রাউতরা বাথান এলাকা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এই বাথান এলাকার ইতিহাস খ্যাত বুড়িপোতাজিয়া কুঠিরভিটা, রাউতগাড়ি, রামকান্তপুর ও হান্নি মৌজায় বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রয়াস ও অর্থায়নে ১০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে দেশের ৩৮ তম পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় ‘রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশ’। সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার পরিচালনা পরিষদের সাবেক পরিচালক নজরুল ইসলাম অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে গোচরন ভূমি বাথানের জমি উদ্ধারের জন্য সরকারের কাছে জোড় দাবি জানিয়েছেন।
মিল্কভিটাভূক্ত কয়েকটি প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর এই বিস্তীর্ণ গোচারণ ভূমিকে (বাথান) কেন্দ্র করে পাবনা-সিরাজগঞ্জের দুগ্ধ অঞ্চলের বাঘাবাড়ীতে বড়াল নদী পাড়ে স্থাপন করা হয় সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা। মিল্কভিটার বাঘাবাড়ী ‘ক’ ও ‘খ’ অঞ্চলে পাঁচ শতাধিক প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতি রয়েছে। সমিতিতে গো-খামারের সংখ্যা রয়েছে প্রায় ২২ সহস্্রাধিক। পাবনার এবং সিরাজগঞ্জের বাথানের জমি মিল্কভিটার নিবন্ধিত দুগ্ধ সমবায় সমিতি গোচরণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বছরের ৯ মাস এই বাথানগুলোতে লক্ষাধিক গরু বিচরণ করে থাকে।
তারা অভিযোগ করেছেন, বাথান কমিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ তদারকির অভাবে মিল্ক ভিটার শত শত একর জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ভূয়া দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে মিল্কভিটার জমি। এই অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে উত্তরের বৃহত্তম গোচারন ভুমি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। আবার কিছু কিছু সমিতির কর্মকর্তারা জমি লীজ নিয়ে ঘাসের পরিবর্তে ধান আবাদ কওে থাকে। এতে বাথানে কাঁচা ঘাসের সঙ্কট দেখা দেয়। প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সদস্যরা বাথানের বেদখল হয়ে যাওয়া জমি দখল মুক্ত এবং ধান আবাদ বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
শাহজাদপুর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, কতিপয় দখলদার উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে এসে জমির মালিকানা দাবি করে। তারা কোন দুগ্ধ সমিতিকে জমি লীজ না দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। ফলে বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়। এরপর ভূয়া আর এস রেকর্ড করার অভিযোগে ওই সব দখলদারদের বিবাদী করে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও শাহজাদপুর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) বাদী হয়ে আদালতে পৃথক ৬টি মামলা দায়ের করেন। শাহজাদপুর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিস মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
একটি মামলায় পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার নাগেেডমরা ইউনিয়নের পাথাইলহাট গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা শামসুল ইসলাম ওরফে নান্নু মিয়া তার স্ত্রী হোসনে আরা বেগম, ছেলে মোঃ আবুল হাসনাত, দুই বোন রেহানা আক্তার ও তাহমিনা বেগমসহ মিল্কভিটার বাঘাবাড়ি কারখানার ব্যবস্থাপক (সমিতি), বাথান কমিটির সদস্য সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে। ওই একই পরিবারের পাঁচ সদস্যের নামে ৮০ দশমিক ১০ বিঘা জমি (২৬ দশমিক ৭৬ একর) আরএস রেকর্ড করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ব্যাপারে শামসুল ইসলাম ওরফে নান্নু মিয়া জানিয়েছেন, এই জমিগুলো আমারা রেকর্ড করি নাই। ওই জমি আমাদের জমির পাশে হওয়ায় তৎকালীন সার্ভের সময় সংশ্লিষ্টরা আমাদের নামে রেকর্ড করে থাকতে পারে। বিষয়টি আমাদের জানা নেই। শাহজাদপুর উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি অফিসের একটি সূত্র জাল দলিল করে জমি জোরপূর্বক ভোগদখলের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছে, এই রেকর্ড ভূয়া এবং অবৈধ। যে জমি খাস খতিয়ান ভূক্ত তা কখনও ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করা সুযোগ নেই। কেউ রেকর্ড করলেও এটি কার্যকর হবে না।
মিল্কভিটার পরিচালনা পরিষদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালক বলেছেন, কিছু অসাধু ব্যক্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে অবৈধভাবে সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার প্রায় এক হাজার ৬৫০ বিঘা (৫৫০ একর) গোচারণ জমি জোড়পূর্বক ভোগদখল করে আসছে। মিল্কভিটার আওতাভূক্ত সমিতিগুলোর সদস্যরা ওই জমি গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে না। অবৈধ দখলদারদের নিকট থেকে গোচারণ ভূমি উদ্ধার ও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া তৎকালীন সময়ে মিল্কভিটায় দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে বেশ কিছু প্রভাবশালী ভূমিদস্যু ভূয়া কাগজপত্র তৈরি মাধ্যমে রেকর্ড করে গোচারণ ভুমি অবৈধভাবে দখলে নিয়েছে। গোচরণ ভূমি উদ্ধারের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*