প্রধান মেনু

মহানবীর (সাঃ) জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্ত ও অন্তিম ওসিয়ত

ইসলামী ডেস্ক।।

অস্থিরতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সমগ্র মদীনা নগরীকে গ্রাস করেছিল। মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ অশ্রুসজল নয়নে এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে মহানবীর অসুস্থতার পরিণতি সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর ঘরের চারপাশে সমবেত হয়েছিলেন।

ঘরের ভেতর থেকে বাইরে আসা খবর মহানবীর স্বাস্থ্যের অবনতি ও সংকটজনক অবস্থার কথাই ব্যক্ত করছিল এবং তাঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি ও আরোগ্য সংক্রান্ত সব ধরনের আশা মিটিয়ে দিচ্ছিল এবং নিশ্চিত করছিল, মহানবীর জীবন প্রদীপের সর্বশেষ শিখা নির্বাপিত হবার আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা অবশিষ্ট আছে।

মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবী নিকট থেকে তাঁদের মহান নেতাকে দেখা ও তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে যে কক্ষের মধ্যে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, সেখানে তাঁর আহলে বাইত ব্যতীত আর কারো পক্ষে যাতায়াত করা সম্ভব ছিল না।

মহানবী (সা.)-এর একমাত্র কন্যাসন্তান হযরত ফাতিমা (আ.) পিতার শয্যার পাশে বসেছিলেন এবং তাঁর উজ্জ্বল মুখমণ্ডলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তিনি যখন পিতার কপাল ও মুখমণ্ডলের উপর মুক্তার দানার মতো মৃত্যু-ঘামের বারিবিন্দুসমূহ ঝরে পড়তে দেখলেন, তখন তিনি ভগ্ন হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত নয়নে এবং রুদ্ধকণ্ঠে মহানবী (সা.)-এর শানে হযরত আবু তালিব রচিত এ কবিতাংশ মৃদু স্বরে আবৃত্তি করছিলেন :

“ঐ উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, যাঁর মর্যাদার উসীলায় মেঘমালার বারিবিন্দুর জন্য প্রার্থনা করা হয়; তিনি অনাথদের আশ্রয়স্থল এবং বিধবা নারীদের রক্ষক।”

এ সময় মহানবী (সা.) চোখ মেলে তাকালেন এবং নিচু স্বরে কন্যার উদ্দেশে বললেন :

“এ কবিতা আবু তালিব আমার শানে আবৃত্তি করেছেন। তবে এর স্থলে পবিত্র কুরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত উত্তম :

و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرسل أفأن مات أو قُتل انقلبتم علي أعقابكم و من ينقلب علي عقبيه فلن يضرّ الله شيئا و سيجزى الله الشاكرين

-মুহাম্মদ শুধু আল্লাহর রাসূল, তাঁর আগে রাসূলগণ প্রস্থান করেছেন। অতএব, যদি তিনি ইন্তেকাল করেন বা নিহত (শহীদ) হন, তা হলে কি তোমরা তোমাদের পেছন দিকে (পূর্বপুরুষদের ধর্মের দিকে) প্রত্যাবর্তন করবে? আর যারা তাদের দিকে ফিরে যাবে, তারা কখনোই মহান আল্লাহর ন্যূনতম ক্ষতিও করতে পারবে না। আর তিনি কৃতজ্ঞ বান্দাদের পুরস্কৃত করবেন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

 

হযরত ফাতিমা (আ.)-এর সাথে মহানবী (সা.)-এর কথোপকথন

অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, নিজ সন্তানদের প্রতি বড় বড় মনীষী ও ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বদের আবেগ-অনুভূতি অধিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মব্যস্ততার দরুন নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। কারণ মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং সর্বজনীন চিন্তা- ভাবনা তাঁদেরকে এতটা আত্মমগ্ন করে রাখে যে, এর ফলে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও আবেগ-অনুভূতি তাঁদের মাঝে বিকশিত হতে পারে না। তবে মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ এ নিয়মের ব্যতিক্রম। সবচেয়ে মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং বিশ্বজনীন ধ্যান-ধারণা ও আদর্শের অধিকারী হওয়া সত্বেও তাঁরা প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী এবং তাঁদের অন্তরাত্মা মহান। আর এ কারণেই জীবনের একটি দিকে ব্যস্ত হওয়া কখনো তাঁদেরকে জীবনের অপর দিক থেকে নির্লিপ্ত করে না।

একমাত্র কন্যাসন্তানের প্রতি মহানবী (সা.)-এর প্রগাঢ় টান ও ভালোবাসা প্রকৃতপক্ষে মানবীয় আবেগ-অনুভূতির সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ। তাই মহানবী কন্যার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে কখনোই সফরে বের হতেন না এবং সফর থেকে ফিরে এসে সর্বাগ্রে তিনি তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ছুটে যেতেন। নিজের স্ত্রীগণের সামনে তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং সাহাবীগণকে বলতেন : “ফাতেমা আমার দেহের টুকরা। যা তাকে সন্তুষ্ট করে, তা আমাকেও সন্তুষ্ট করে; আর তার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি আমারই ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি।”

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সাক্ষাৎ মহানবী (সা.)-কে বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্রা ও মমতাময়ী নারী হযরত খাদীজার কথা স্মরণ করিয়ে দিত, যিনি তাঁর স্বামীর পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে বিস্ময়কর সব দুঃখ-কষ্ট বরণ করে নিয়েছিলেন এবং এ পথে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি ব্যয় করেছিলেন।

যে কয়েকটি দিন মহানবী (সা.) শয্যাশায়ী ছিলেন, সে ক’টি দিন হযরত ফাতিমা (আ.) পিতার শয্যা পাশে বসে থাকতেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও পিতার কাছে থেকে দূরে সরেন নি। হঠাৎ মহানবী (সা.) ইঙ্গিতে বোঝালেন, তিনি তাঁর সাথে কথা বলবেন। নবীকন্যা একটু ঋজু হয়ে মহানবীর কাছে মাথা নিয়ে গেলেন। তখন মহানবী (সা.) তাঁর সাথে আস্তে আস্তে কথা বললেন। যাঁরা তাঁর শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের কেউ মহানবী ও তাঁর কন্যার কথোপকথনের বিষয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত হতে পারেন নি। মহানবী কথা বলা শেষ করলে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) কাঁদলেন এবং তাঁর দু’চোখ বেয়ে বন্যার স্রোতের মতো অশ্রু প্রবাহিত হতে লাগল। এ অবস্থায় মহানবী (সা.) তাঁকে আবার ইশারা করে কাছে ডেকে তাঁর সাথে আস্তে আস্তে কথা বললেন। এবার হযরত যাহরা (আ.) হাসিমুখে মাথা উঠালেন। একই সময় পরস্পর বিপরীত এ দুই আচরণ উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে বিস্মিত করেছিল। তাঁরা নবীকন্যার কাছে অনুরোধ করলেন যেন তিনি তাঁর সাথে মহানবীর যে কথা হয়েছে, তা তাঁদের জানান এবং এ দুই অবস্থার উদ্ভবের কারণও তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু যাহরা (আ.) বললেন : “আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর রহস্য ফাঁস করব না।”

মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর হযরত যাহরা (আ.) হযরত আয়েশার পীড়াপীড়িতে তাঁদেরকে ঘটনার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত করেন এবং বলেন : “আমার পিতা প্রথমে তাঁর ইন্তেকালের কথা জানিয়ে বলেন : আমি এ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করব না। এ কারণেই আমার তখন কান্না পেয়েছিল। তবে পরে তিনি আমাকে বললেন : আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে তুমিই প্রথম, যে আমার সাথে মিলিত হবে। এ সংবাদ আমাকে আনন্দিত করল এবং আমিও বুঝতে পারলাম, অল্প কিছুদিন পরেই আমি পিতার সাথে মিলিত হব।”

দাঁত মুবারক মিসওয়াক

মহানবী (সা.) রাতের বেলা ঘুমানোর আগে এবং ঘুম থেকে জাগার পর মিসওয়াক করতেন। মহানবীর মিসওয়াক আরাক কাঠের ছিল, যা দাঁতের মাড়ি মজবুত করা এবং ময়লা ও খাদ্যকণা পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। একদিন হযরত আয়েশার ভাই আবদুর রহমান একটি সবুজ ও তাজা ডাল হাতে নিয়ে মহানবী (সা.)-কে দেখতে আসেন। হযরত আয়েশা মহানবীকে ঐ ডালটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলেন, তিনি ডালটি দিয়ে মিসওয়াক করতে চাচ্ছেন। তাই তিনি তা নিয়ে মহানবীর হাতে রাখলেন। আর তখন মহানবী খুব যত্নের সাথে দাঁত মিসওয়াক করলেন।

মহানবী (সা.)-এর অন্তিম ওসিয়ত

মহানবী (সা.) অসুস্থ থাকার দিনগুলোয় প্রয়োজনীয় বিষয়াদি স্মরণ করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন এবং তাঁর অসুস্থতার শেষ দিনগুলোয় নামায আদায় এবং দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিতেন এবং বলতেন : “তোমরা দাস-দাসীদের সাথে সদাচরণ করবে, তাদের খাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে খেয়াল রাখবে, তাদের সাথে কোমল ভাষায় কথা বলবে এবং মানুষের সাথে সুন্দরভাবে মেলামেশা ও জীবন যাপন করবে।”

একদিন কা’ব আল আহবার দ্বিতীয় খলীফাকে জিজ্ঞেস করলেন : “মহানবী (সা.) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার অবস্থায় কী বলেছিলেন?” দ্বিতীয় খলীফা সভায় উপস্থিত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন : “আপনি তাঁকে জিজ্ঞেস করুন।” আলী (আ.) বললেন : “মহানবী (সা.)-এর মাথা যখন আমার কাঁধের উপর রাখা ছিল, তখন তিনি বলছিলেন: (الصّلوة الصّلوة) নামায, নামায।” এ সময় কা’ব বললেন : “পূর্ববর্তী নবীগণও এ পদ্ধতির ওপর বহাল ছিলেন (অর্থাৎ তাঁরাও ওফাতকালে নামাযের ব্যাপারেই তাঁদের উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন)।”

জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোয় মহনবী (সা.) চোখ খুলে বললেন : “আমার ভাইকে ডাক যাতে সে এসে আমার শয্যার পাশে বসে।” সবাই বুঝতে পারলেন, তাঁর এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছেন আলী। আলী (আ.) তাঁর শয্যার পাশে এসে বসলেন। তিনি অনুভব করলেন, মহানবী (সা.) বিছানা থেকে উঠতে চাচ্ছেন। আলী (আ.) মহানবীকে বিছানা থেকে উঠালেন এবং নিজের বুকের সাথে তাঁকে হেলান দিয়ে ধরে রাখলেন।

আর ঠিক তখনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার লক্ষণগুলো মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহে প্রকাশ পেল। এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করেছিল : “মহানবী (সা.) কার বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন?” তখন ইবনে আব্বাস বলেছিলেন : “মহানবী (সা.) আলীর কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।” ঐ লোকটি আবার বলল : “হযরত আয়েশা দাবী করেন, মহানবী তাঁর বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।” ইবনে আব্বাস হযরত আয়েশার কথা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন : “মহানবী (সা.) হযরত আলীর কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আর আলী ও আমার ভাই ফযল তাঁকে গোসল দিয়েছেন।”

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর এক ভাষণে এ বিষয় স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছেন :

و لقد قُبض رسول الله و إنّ رأسه لعلي صدرى… و لقد ولّيت غسله و الملائكة أعوانِى

“মহানবী (সা.) আমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন… আমি তাঁকে গোসল দিয়েছি এবং ঐ অবস্থায় ফেরেশতারা আমাকে সাহায্য করেছেন।”

কতিপয় মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্তে সর্বশেষ যে কথা বলেছিলেন, তা ছিল لا، مع الرّفيق الأعلي (না, বরং সবচেয়ে মহান বন্ধুর সাথে) যেন ওহীর ফেরেশতা তাঁর রূহ কবজ করার সময় তাঁকে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে এ পার্থিব জগতে প্রত্যাবর্তন বা ফেরেশতা কর্তৃক তাঁর রূহ কবজ করা ও অন্য জগতে (বারযাখে) দ্রুত চলে আসার মধ্যে যে কোন একটি বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিলে তিনি এ বাক্য বলে ফেরেশতাকে জানিয়েছিলেন, তিনি মৃত্যুপরবর্তী জগতে চলে যেতে এবং সেখানে নিম্নোক্ত আয়াতে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সাথে বসবাস করতে চান।

)فأولئك مع الّذين أنعم الله عليهم من النّبيّين و الصّدّيقين و الشّهداء و الصّالحين و حسن أولئك رفيقا(

“তাঁরা ঐ ব্যক্তিদের সাথে আছেন যাঁদের ওপর মহান আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন; আর এসব অনুগ্রহপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ হচ্ছেন নবী, পরম সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীল বান্দাগণ এবং তাঁরা কত (উত্তম) ভালো বন্ধু!”

মহানবী (সা.) এ বাক্য বললেন এবং সাথে সাথে তাঁর দু’চোখ ও ওষ্ঠ বন্ধ হয়ে গেল।

মহানবী (সা.)-এর ওফাত দিবস

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মহান আত্মা ২৮ সফর সোমবার দুপুর বেলা চিরস্থায়ী আবাসস্থলের দিকে উড়ে যায়। তখন তাঁর পবিত্র দেহ একটি ইয়েমেনী চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় এবং অল্প সময়ের জন্য কক্ষের এক কোণে রেখে দেয়া হয়। মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণের বিলাপ এবং নিকটাত্মীয়গণের ক্রন্দনধ্বনি শুনে বাইরে অবস্থানরত জনতা নিশ্চিত হন যে, মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মহানবী (সা.)-এর ওফাতের সংবাদ সমগ্র মদীনা নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর কতিপয় কারণবশত ঘরের বাইরে চিৎকার করে বলেছিলেন : “মহানবী (সা.) মৃত্যুবরণ করেন নি এবং তিনি মূসা (আ.)-এর মতো মহান আল্লাহর কাছে গেছেন” এবং এ ব্যাপারে তিনি মাত্রাতিরিক্ত তাকীদ দিতে লাগলেন এবং তিনি একদল জনতাকে তাঁর অভিমতের সমর্থকও প্রায় বানিয়ে ফেলেছিলেন। ইত্যবসরে মহানবী (সা.)-এর একদল সাহাবী নিম্নোক্ত আয়াত হযরত উমরকে পাঠ করে শোনালেন :

و ما محمّد إلّا رسول قد خلت من قبله الرسل أفأن مات أو قُتل انقلبتم علي أعقابكم

“মুহাম্মদ কেবল আল্লাহর রাসূল; তাঁর আগে রাসূলগণ গত হয়ে গেছেন। যদি তিনি ইন্তেকাল করেন বা নিহত হন, তা হলে কি তোমরা তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে?”

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দেহ মুবারক গোসল দেন এবং কাফন পরান। কারণ মহানবী (সা.) বলেছিলেন : “আমার সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি আমাকে গোসল দেবে।” আর এ ব্যক্তি আলী ব্যতীত আর কেউ ছিলেন না। যা হোক, এরপর তিনি মহানবীর পবিত্র মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করলেন। তখন তাঁর দু’নয়ন বেয়ে প্লাবনের মতো অশ্রু ঝরছিল। তিনি তখন এ কথাসমূহ বলছিলেন : “আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন। আপনার ওফাতের মাধ্যমে নবুওয়াতের সূত্র ছিন্ন এবং মহান আল্লাহর ওহী ও আকাশের (ঊর্ধ্ব জগতের) খবরা-খবর বন্ধ হয়ে গেল, যা অন্য কারো মৃত্যুতে কখনো বন্ধ হয় নি। আপনি যদি আমাদের অপ্রীতিকর অবস্থায় ধৈর্যধারণ করার আহবান না জানাতেন, তা হলে আমি আপনার বিচ্ছেদে এতটা কাঁদতাম ও অশ্রু ঝরাতাম যে, এর ফলে আমি অশ্রুর উৎসই শুষ্ক করে ফেলতাম। তবে এ পথে আমাদের দুঃখ ও শোক সর্বদা বিদ্যমান থাকবে। আপনার পথে এ পরিমাণ শোক আসলে নগণ্য এবং এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোন। আমাদেরকে আপনি পরলোকে স্মরণ করুন এবং স্মরণে রাখুন।”

সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর জানাযার নামায আদায় করেন, তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)। অতঃপর মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ দলে দলে এসে তাঁর জানাযার নামায আদায় করলেন। আর এ অনুষ্ঠান মঙ্গলবারের দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকে। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, মহানবী (সা.) যে কক্ষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, সেখানেই তাঁকে দাফন করা হবে। তাঁর কবর আবু উবাইদাহ্ ইবনে জাররাহ্ এবং যাইদ ইবনে সাহল প্রস্তুত করেছিলেন। হযরত আলী (আ.), ফযল ও আব্বাসের সহায়তায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দাফন কাজ সম্পন্ন করেন।

পরিণামে, যে ব্যক্তিত্ব তাঁর নিরলস আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানব জাতির ভাগ্যে পরিবর্তন এনেছিলেন এবং তাদের সামনে সভ্যতার এক নতুন ও উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবতারণা করেছিলেন, তাঁর ইহজীবন-সূর্য অস্ত গেল। তাঁর ওফাতের সাথে সাথে তাঁর মহতী রিসালতী মিশন অব্যাহত রাখা এবং তাঁর মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে অনেক বাধা ও সমস্যার উদ্ভব হয়, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট সমস্যা ছিল খিলাফত ও মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব বিষয়ক সমস্যা। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের আগেই মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভক্তির লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।# ( আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানীর ‘চিরভাস্বর মহানবী-সা’ শীর্ষক বই থেকে সংগৃহীত)






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*