প্রধান মেনু

গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী নন

 

 

জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট ।।

ক’দিন আগে আস্থা নামের এক তরুণী মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে টুইট করলে চাঞ্চল্যে সৃষ্টি হয়, খুব অল্প সময়ে ভাইরাল হয় তার পোস্ট।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদ করে, কেউবা অশ্লীল মন্তব্য করতে থাকে মা ও মেয়ে উভয়কেই। প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটি আমাদেরই কেউ, এদেশীয়। পরে জানলাম মেয়েটি প্রতিবেশী দেশ, ভারতীয়।

আমি কিন্তু অন্য অনেকের মতো গালমন্দ করতে যাইনি মোটেও। আমার বরং ভালো লেগেছে, মায়ের প্রতি সন্তানের এই ভালবাসার জন্য। মায়ের নিঃঙ্গতা অনুভব করবার জন্য।

আমাদের চিন্তার দৈন্যতা আমাকে বরাবরই কষ্ট দেয়। আমরা খুব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে, সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ঘুরপাক খাই। সবকিছুকে ‘যৌন’ আর ‘যৌনতা’র মাপকাঠিতে বিচার করতে চাই। কিছুতেই এর ঊর্ধ্বে উঠে, বৃত্ত ভেঙে ভাবতে পারি না, চিন্তা করতে পারি না।

প্রতিটি সম্পর্কের চেহারা চরিত্রে যৌনতা খুঁজে বেড়াই। হোক সেটি নারী-পুরুষে, পুরুষে-পুরুষে, এমনকি নারী-নারীতে।

একটা কথা আমি প্রায়ই বলি যে, বৃত্তের বাইরেও জীবন আছে। প্রচলিত বৃত্তের যে পরিচিত চেহারা, তার বাইরেও বিপুল বিশাল জীবন ও জগৎ বর্তমান।

‘হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন বিয়ে করেছেন’- খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেবল নয়, গণমাধ্যমেও তোলপাড়। গুলতেকিনকে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী বা প্রথম স্ত্রী কেন বলছি? এটিই কি গুলতেকিনের বর্তমান পরিচয়? বিয়েতো একটা ‘অফিসিয়াল’ সম্পর্ক।

কোন চিরস্থায়ী সম্পর্ক নয়। তাহলে যে ‘গুলতেকিন আহমেদ’ অনেককাল আগে হুমায়ূনের সঙ্গে ডির্ভোস নিয়ে শুধু ‘গুলতেকিন’ পরিচয়ে পরিচিত, তাকে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী বলাটি অন্যায়। সেই পরিচয়ে থাকতে চান না বলেই তো তিনি ডিভোর্স নিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।

আমরা পোশাকে কেতাদুরস্ত, স্মার্ট ফোনে অভ্যস্থ। কিন্তু ভেতরে আনস্মার্ট। চিন্তায় অনগ্রসর, মগজে পুরুষতান্ত্রিক, রুচিতে অসভ্য।

একজন গুলতেকিনকে সারাজীবন হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী এই পরিচয়ে বেঁচে থাকতে হবে- চাই। এর বাইরে গেলেই সে নষ্ট। সতীদাহ প্রথার উন্নত সংস্করণ আমরা।

আমি তো দেখেছি শুধু বিয়ে কেন, কোন একটি ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের সম্পর্ক ভেঙে গেলতো তাকে নিয়ে লোকের বাঁকা চোখ, কুমন্তব্য, অশ্লীল আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।

এখনও কালো মেয়ে অপয়া, ডিভোর্স মানে দুঃচরিত্রা, একা মেয়ে মন্দ মেয়ে- সমাজে। আর নারীর দ্বিতীয় বিয়ে? এ যেন মহাপাপ, মহাঅন্যায়!

গুলতেকিন কবি, পেশায় শিক্ষক। একজন স্বাধীন স্বতন্ত্র মানুষ। যিনি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ডিভোর্সেও ভেঙে পড়েননি। সংগ্রাম করেছেন। সন্তানদের মানুষ করেছেন। প্রেমতো অন্যায় কিছু নয়, অপরাধ নয়। প্রেমে তো তিনি পড়তেই পারেন।

তিনি তো হুমায়ুনের মতো একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন অন্যতে জড়াননি। অমনতো নয় তিনি অসভ্য বহুগামী। তিনি তার চেয়ে কম বা বেশি বয়সী আরেকজন ডিভোর্সি পুরুষকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, এটি একান্তই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।

ভালো লেগেছে মায়ের বিয়ে নিয়ে হুমায়ূন-গুলতেকিন পুত্র নুহাশের মতামত। চিন্তায় প্রচন্ড আধুনিক সে। যিনি অকপটে বলেছেন, ‘মা শক্ত হাতে আমাদের বড় করেছেন। কখনো কোনো অভাব বুঝতে দেয়নি। মা সবসময়ই আমাদের কাছে আইডল।

মা যখন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তখন আমার কোনো দুঃখবোধ ছিল না। বরং আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমি মায়ের সঙ্গেই ছিলাম এ ব্যাপারে। তাদের জন্য সকলের কাছে দোয়া চাচ্ছি। আমি নিজে থেকে মায়ের বিয়ে দিয়েছি। আর এটা লুকানোর কিছু নেই। সামনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও হবে। এটা নারীদের জন্য নতুন একটা দ্বার উম্মোচন হলো বলতে পারেন।’

সত্যিই চমৎকার, উদার মন্তব্য ও মানসিকতা। তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়? আমরা কেন অন্যের বিয়ে নিয়ে, জীবন নিয়ে, জীবন-যাপন নিয়ে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত। একজন গুলতেকিন এই বয়সে এসে কেন বিয়ে করেছেন সেটি তিনিই জানেন, বোঝেন।

জীবনের বোধ ও গভীরতা যার যার একান্ত নিজস্ব। কারো ব্যক্তিগত জীবনে অনুপ্রবেশ, অন্যের বেডরুমে অতর্কিত ঢুকে পড়ার মতোই অশ্লীল। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরি।

শুধু গুলতেকিন কেন, কাল হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওনও যদি বিয়ে করেন মোটেও বিস্মিত হবো না আমি। কেননা, শাওনের জীবনটি শুধু মাত্র শাওনই জানেন। আর সেটি যাপন করবার অধিকার একান্ত তারই।

জীবন আসলে বহতা নদীর মতো। বড্ড অনিশ্চয়তার এ জীবন। যেখানে শুরু বলে মনে করছি, হয়তো সেখানেই শেষ। যেখানে শেষ বলে ভাবছি, সেখান থেকেই হয়তো নতুন জীবনের শুরু।

জীবন আসলে এমনই।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*