প্রধান মেনু

অসময়ে যমুনার ভাঙন ! চৌহালীর মিটুয়ানী গ্রামে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত শতাধিক পরিবারের মানবেতর জীবন

শফিউল আযম, পাবনা থেকে ।।
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার মিটুয়ানী গ্রাম জুড়ে অসময়ে শুরু হয়েছে যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন। গত এক সপ্তাহের ভাঙ্গনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। তারা আশ্রয় নিয়েছেন পাশের রেহাইপুখুরিয়া গ্রামের পাকা সড়কের ধারে। পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ খোলা আকাশের নিচে অথবা টিনের ঝুপড়ি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে এ গ্রামের একটি কবরস্থান, একটি মসজিদ, শতাধিক বসতবাড়ী, ২০টি তাঁত কারখানাসহ প্রায় এক কিলোমিটার পাকা সড়ক।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের কোন খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। নদী ভাঙনে অনেক স্বচ্ছল পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে এখন পথের ভিখারীতে পরিণত হয়েছেন।

অনেকেই সড়কের পাশে টিনের ঝুঁপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে ছোট ছোট শিশু সন্তান নিয়ে অতিকষ্টে দিন যাপন করছেন। সেখানে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যমুনা গর্ভে সড়ক বিলীন হওয়ায় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী ও পথচারীদের বাধ্য হয়ে কারো বাড়ির উঠন অথবা ঘরের বারান্দা দিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
খাসপুখুরিয়া ইউনিয়নের মিটুয়ানী গ্রামের আবু দাউদ মাস্টার, আব্দুর রহমান, রুহুল আমীন, আব্দুল কাদের, লুৎফর রহমান, ইয়াসিন আলী, ইসমাইল হোসেন, আখলিমা খাতুন, আব্দুল হালিম, আব্দুর রহিম, আতিক মোল্লা, আব্দুল মালেক, নাসির উদ্দিন, গোলাম হোসেন, বাচ্চু মোল্লা, ফজিলা খাতুন, কামরুল ইসলাম, হারুন আরকাটি, আক্কাস মোল্লা, রহিম আরকাটি, আবু বাক্কার জানিয়েছেন, এক মাস ধরে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। তবে গত এক সপ্তাহের তীব্র ভাঙনে শতাধিক বাড়িঘর, পাকা সড়ক, গাছপালা ও ফসলি জমি নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো রেহাইপুখুরিয়া গ্রামের পাকা সড়কের ধারে আশ্রয় নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপণ করছেন।
তারা আরো বলেছেন, গত পাঁচ বছরে যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে চৌহালী উপজেলার খাষপুখুরিয়া থেকে বাঘুটিয়া ইউনিয়নেরর ভুতেরমোড় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এলাকার সাড়ে চার হাজার ঘরবাড়ি, ১৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তিন কিলোমিটার পাকা সড়ক, তিনটি মসজিদ, দুই হাজার বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গত বর্ষা মওসুমের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যমুনার ভাঙ্গনে মিটুয়ানী ও খাষপুখুরিয়া ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে দুই শতাধিক পরিবার তাদের মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়েছেন। এরমধ্যে ১৫ সদস্যের তিনটি পরিবার নদীর পাশে অবস্থিত শত বছরের একটি কবরস্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে কবরস্থানটি যমুনা নদীতে বিলীন হওয়ায় তারা পাশের গ্রামের সড়কের ধারে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
কবরস্থানে আশ্রয় নেয়া বয়োবৃদ্ধ আতর আলী (৭৫) জানিয়েছেন, প্রয়োজন কোন আইন কানুন মানে না। কবরস্থানে বসবাস ধর্মীয় বিধান বর্হিভূত। তবে নিরুপায় হয়ে কবরস্থানের জায়গায় ঘর তুলে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেছি। এখান সেটিও ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে চরম বিপাকে পড়েছি। এই বয়সে ছেলে মেয়ে নাতি পুতি নিয়ে কোথায় যাব। যাওয়ার জায়গা খুজে পাচ্ছি না।
সোমবার দুপুরে সরেজমিন মেটুয়ানী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মানুষজন তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছে। অনেকেই পৈত্তিক ভিটা হারিয়ে নদীপাড়ে বসে আহাজারি করছে। অনেকে গাছপালা কেটে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নদীর পাড় বাড়ির ভিটা থেকে খাড়া হয়ে ৩০ ফুট নিচে নেমে গেছে। পানির ঘুর্ণায়মান ¯্রােতের টানে বিশাল এলাকাব্যাপী বড় বড় ফাটল সৃষ্টি হয়ে মূহুর্তে তা ধসে পড়ছে। এই ভাঙ্গনের তান্ডবলীলায় পুরো গ্রাম জুড়ে ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে খাসপুখুরিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড মেম্বর রবিউল ইসলাম জানান,ভিটামাটি হারানো এ সব পরিবার গুলোকে মানবিক কারণেই দ্রæত পূণর্বাসন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকে বলেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন এসেও ভাঙ্গণ এলাকার মাপঝোক নিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও এখনও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে মেটুয়ানী গ্রামের একটি বাজার,একটি হাই স্কুল,একটি প্রাইমারি স্কুল,একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসা,দেড় শতাধিক বাড়িঘর,পাশের দেওয়ানগঞ্জ বাজার ভাঙ্গণের মুখে পড়েছে।
চৌহালী উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও খাসপুখুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ সরকার জানিয়েছেন, নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থদের পূণঃবাসনের পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছে। তবে এখনো তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা বিভিন্ন সড়ক ও পরিত্যাক্ত জায়গায় আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছি। তারা দ্রæত ব্যবস্থা নিবেন বলে জানিয়েছেন। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে লোকজন এসে মাপঝোক নিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও কাজ শুরু করেনি। ফলে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা ভাঙছে। বিলিন হচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলি জমি। এতে নিঃস্ব হচ্ছে এলাকার মানুষ।
নদী ভাঙন সম্পর্কে চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মওদুদ আহাম্মেদ জানিয়েছেন, মিটুয়ানী গ্রামে ভাঙ্গনের বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ও সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। আশ্রয়হীনদের দ্রæত সময়ের মধ্যে পুণর্বাসনের চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেছেন, যমুনা নদীর পূর্বপাড়ের চৌহালী অংশ টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখে। এ বিষয়ে তারাই ভাল বলতে পারবেন।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, জরুরী ভিত্তিতে ভাঙনরোধে আমাদের নগদ অর্থ বরাদ্দ নেই। বরাদ্দ পেতে প্রায় এক বছর সময় লাগবে। এদিকে নদী ভাঙ্গনে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে চাইলেও অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কোন ঠিকাদার কাজ করতে রাজি হচ্ছে না। ফলে ভাঙনরোধ কাজ শুরু করতে হচ্ছে। তবে আমার অনুরোধে দু‘জন ঠিকাদার বাকিতে কাজ করতে রাজি হয়েছেন। আশাকরছি এ সপ্তাহের মধ্যেই ভাঙনরোধ কাজ শুরু করা যাবে।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*