প্রধান মেনু

প্রায় ৩১ হাজার জেলে ও মাঝিমাল্লা বেকার

পাবনার ২০ নদীর ১৬টি মৎস্য খামার ও ফসলী জমিতে পরিনত

শফিউল আযম, পাবনা থেকে ।।
পাবনা জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২০টি নদী পানির অভাবে শীতকালেই মরা নদীতে রুপ নিয়েছে। এরমধ্যে ১৬টি নদী মৎস্য খামার ও ফসলী জমিতে পরিনত হয়েছে। চারটি নদীতে মারাত্মক নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে জেলার ৬২৮ কিলোমিটার নৌপথের মধ্যে কোন রকমে টিকে আছে মাত্র ১০৮ কিলোমিটার নৌপথ। ক্রমাগত পলি জমে ভরাট হয়ে ৫২০ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।

পণ্যসামগ্রীর আমদানি রফতানি সড়কপথের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মাধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৩১ হাজার জেলে ও নৌকার মাঝিমাল্লা বেকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।
জানা যায়, ১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাবনা জেলার বিভিন্ন নৌরুটে লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করত। এখন জেলার নদীপথ বছরব্যাপী সচল থাকে না। নাব্যতা ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্পর্কে সুচিন্তিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকারি পর্যায়ে জেলার নদীগুলো সম্পর্কে একটা অদ্ভূত উদাসীন মনোভাব পোষণের কারণে আজ বিপর্যস্ত নৌপথ। প্রায় ১২ বছর হয়ে গেল কাজীরহাট ঘাটে ফেরি ভিড়ে না।

পল্টুন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বেড়ায় নৌবন্দর পরিকল্পনা আংশিক বাস্তবায়নের পর পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়েছে।
বর্ষাকালে পাবনার ধান, চাল, পাট, মাছ, গুড়, গবাদীপশুসহ বিভিন্ন পণ্য এখনো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বেড়া ডাকবাংলা ঘাট থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে রফতানি করা হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নদী পথের নাব্যতা রক্ষা ও উন্নয়নে কাজীরহাট ঘাট, বাঘাবাড়ীর ভাটিতে হুড়াসাগর ও যমুনা নদী ছাড়া আর কোথাও ড্রেজিং করা হয় না। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য ঋতুতে নৌপথ কমে যাওয়ায় গুরুত্ব কমে গেছে নৌযানের। নৌকার প্রায় ১০ হাজার মাঝিমাল্লা এবং ২১ হাজার জেলে বেকার হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।

নদী পথে যাতায়াত আগের মতোই এখনো সুলভ। প্রতি লিটার জ্বালানীতে নৌপথে ২১৭ টন মালামাল পরিবাহিত হয় এক কিলোমিটার পথ। অথচ সড়ক পথে ডিজেল চালিত ট্রাকে এক লিটার জ্বালানীতে এক টন মালামাল এক কিলোমিটার বহন করা যায়। নিয়মিত নদী ড্রেজিং না করায় নৌপথ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জেলায় সারা বছর কতটুকু নৌপথ চালু থাকে তারও জরিপ করা হয় না। ১২ মাস পানি থাকে এমন নদী পদ্মা ও যমুনাতে বিশাল বিশাল চর জেগে ওঠায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে মালবাহী জাহাজ।

পাবনা জেলার পূর্ব প্রান্তে যমুনা নদী ৮০ মাইল সীমান্ত রচনা করে মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাকে আলাদা করেছে। পৌষ মাসেই যমুনায় বিশাল বিশাল চর ও বালিয়াড়ি জেগে উঠেছে। এ নদীতে বার মাস নৌযান চলাচল করতে পারে। কিন্তু শুস্ক মওসুমে বিঘœ ঘটে। নদীতে নাব্যতা থাকে না বলে স্থানে স্থানে ড্রেজিং করে নৌপথ চালু রাখা হয়। বছরের সব সময় এ নদী দিয়ে বড় মালবাহী জাহাজ, লঞ্চ ও নৌকা চলাচল করে। যমুনা নদী দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। ইছামতির ৫০ কিলোমিটার পথ পরিত্যাক্ত হয়ে আছে। আগে বেড়া থেকে ভাঙ্গুড়ার বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল। সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে কেবল কাজীরহাট পাটুরিয়া। জেলার বড়াল, গুমানী ও চন্দ্রাবতীতে বর্ষাকালে মালবাহী নৌকা চলাচল করে। কিন্তু অন্যান্য সময়ে নদীতে পানি থাকে না। ভরাট হয়ে গেছে আত্রাই নদী।

পদ্মা নদী অববাহিকার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পদ্মা ছিল স্থানীয় যোগাযোগ ও বাণিজ্যের চালিকাশক্তি, তেমনি ছিল সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা, বার্জ, জাহাজ, কার্গোজাহাজে পণ্য সামগ্রী আনা-নেয়া হতো পদ্মা নদী পথে। চলতো বড় বড় লঞ্চ ও ষ্টিমার। এই অঞ্চলের শতকরা নব্বইভাগ অধিবাসীই ছিল পদ্মা নদীর উপর নির্ভরশীল। ভারত উজানে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করায় ভাটিতে পদ্মা নদী সংঙ্কুচিত হতে থাকে, পানি প্রবাহ হৃস পায়। এর ফলে পরিবর্তিত হতে থাকে পরিবেশ ও পদ্মা পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা।

পদ্মা অববাহিকার অর্থনীতি মূলত কৃষি, মৎস্য ও গবাদীপশুসম্পদ নির্ভর। ধান, চাল, মসুর, খেসারী, সরিষা, মাসকালাই, পাট প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য পদ্মা অববাহিকার সুখ্যাতি ছিল। নৌপথে পদ্মা পাড়ের ফসল যেত চাঁদপুর, চট্রগ্রাম, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
পাবনা জেলার দক্ষিণ পশ্চিম সীমানায় পদ্মা নদীর ৫৫ কিলোমিটার, পূর্ব দিকে যমুনা নদীর ২০ কিলোমিটার, উত্তর দিরে হুড়াসাগর নদের আট কিলোমিটার এবং বড়াল নদীর ২৫ কিলোমিটার নদীপথ কোনো মতে টিকে আছে। সামান্য নৌপথ রয়েছে গুমানী নদীতে। সুতিখালির পাঁচ কিলোমিটার নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে। রতœাই, আত্রাই, চিকনাই, চন্দ্রাবতী, কাকেশ্বরী, বাদাই ও ইছামতি নদীতে বর্ষাকালে মাছ চাষ হয়। শুস্ক মওসুমে বিভিন্ন রকম ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। জেলা প্রশাসন এসব নদী ইজারা দিয়ে থাকে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে রুকনাই, বারনাই, ট্যাপাগাড়ী, গোহালা, শালিকা, শুটকিদহ ও ভাঙ্গুড়ার ইছামতি নদী। ইছামতি নদীতে ৫০ কিলোমিটার নৌপথ ছিল। চিকনাই ৩৮ কিলোমিটার ও আত্রাই ৩০ কিলোমিটার।

এখন এসব নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বড়াল ও ইছামতি নদীর খাত সাঁথিয়ার বোয়ালমারীর কাছে দ্বিখন্ডিত হয়ে আত্রাই নামে পূর্ব দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীতে মিলিত হয়। এক সময় আত্রাই নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। বিপুল পলিমাটির অবক্ষেপণে আত্রাই নদী ভরাট হয়ে যায়। জেলায় যাতায়াতের একমাত্র উপায় ছিল নদী পথ। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকালে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মান করায় নদী পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার নৌরুটগুলোর বেশির ভাগ অংশ ক্রমাগত পলি জমে চর পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্য আমদানি রফতানিতে ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। শুস্ক মওসুমে বিরাজ করে মরুভূমির মতো অবস্থা। পণ্যসামগ্রী আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা নির্ভরশীল হচ্ছেন সড়ক পথের ওপর।

ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলা মিলে বড়াল নদী রয়েছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার। বসন্ত ও গ্রীস্মকালে পানি থাকে না। এ নদীর গভীরতা বর্তমানে তিন মিটার দাঁড়িয়েছে। চার মাসও নৌকা চলে না। গোমানী নদীর নাব্যতা থাকেনা পাঁচটি ঋতুতে। বাঘাবাড়ীর কাছে বড়াল ও করতোয়ার মিলিত প্রবাহ হুড়াসাগর নদ নামে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। বড়াল নদী পথে মিল্কভিটার সদস্যরা দুধ সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু নৌপথ অচল হয়ে পড়ায় তরল দুধ সরবরাহে তাদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গোহালা নদীকে মধ্যবর্তী একটি চর বিভক্ত করে রেখেছে। কিন্তু বর্ষাকালে এই চর তলিয়ে গেলে নদী তখন বিভক্ত থাকে না। একত্র হয়ে যায়। তখন নৌযান যাতায়াত বাড়ে।
পদ্মা নদী পাবনায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিন সীমান্তজুড়ে প্রবাহিত। এ নদীতে আগে স্টিমার, মালবাহী বড় বড় নৌকা যাতায়াত করত। পানির স্তর কমে যাওয়ায় এ নদীতে লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা চলাচল করে না। জেলার বিরাট এলাকাজুড়ে বছরের বেশির ভাগ সময় পানিমগ্ন থাকত। বর্ষাকালে স্বভাবতই প্রায় সব রাস্তাঘাট ডুবে যেত। কয়েক বছর আগেও নৌপথই সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। সড়ক পথের তুলনায় নৌপথই জনপ্রিয় ছিল।

পদ্মার শাখা নদী ও বিলের ওপর দিয়ে পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত। এখন কেবল বর্ষাকালে চাটমোহর, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া এলাকায় পণ্যবাহী পানসি, কোশা ও ডিঙ্গি নৌকা চলাচল করে। ছোট ছোট নৌকায় নদীপথে পাট ও তেলবীজ যেত বৃহত্তর পাবনার সিরাজগঞ্জ, বেড়া ও নাকালিয়া ঘাটে। তারপর বড় বড় নৌকা বোঝাই হয়ে চালান যেত কলকাতায়। তখন বৃহত্তর পাবনা জেলার বিশাল বানিজ্যকেন্দ্র ছিল সিরাজগঞ্জ ও বেড়া বন্দর।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*