প্রধান মেনু

নেছারাবাদের সম্ভাবনাময় জাহাজ শিল্প, কর্মসংস্থান হতে পারে লাখো মানুষের

 
বদরুজ্জামান সুজন, নেছারাবাদ  (পিরোজপুর)।।

ছারছীনা দরবার শরীফের পীর নেছার উদ্দিন সাহেবের জন্মস্থান পূণ্যভূমি পিরোজপুরে নেছারাবাদ উপজেলা। এই উপজেলা নারকেলের ছোবড়া, ক্রিকেটের ব্যাট, রোপ শিল্প, কাঠ ব্যবসা ও নার্সারির জন্য খ্যাত, এই সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প , ডকইয়ার্ড।

নেছারাবাদ নদী-খালবেষ্টিত হওয়ায় পণ্য পরিবহনে নৌ-পথই ভরসা।৮০’র দশকে ট্রলার মেরামত ও তৈরির জন্য গড়ে ওঠে ডকইয়ার্ড। ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায়, বাড়তে থাকে ডকইয়ার্ডের সংখ্যা, রূপ নেয় মানসম্পন্ন জাহাজ তৈরি শিল্পের, ৩০ বছর ধরে জাহাজ  নির্মাণের কাজ চলছে। আগে হাতেগোনা কয়েকটি ডকইয়ার্ডে ছোট আকৃতির জাহাজ তৈরি হলেও বিগত ৫ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে এ শিল্প। ফলে ৩০ টিরও বেশি ডকইয়ার্ডে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫ সহস্রাধিক মানুষের।

এর সাথে সাথে এইসকল ডকইয়ার্ড পরিচালনা করতে কর্মসংস্থান হয়েছে  আরো ১৫ হাজারের বেশি শ্রমজীবী মানুষের। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরণের ওয়ার্কশপ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, হার্ডওয়্যার, রং সহ স্টিলপাতের শতাধিক প্রতিষ্ঠানে এইসকল বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরী হয়েছে। শুধু নেছারাবাদ উপজেলা নয়, বিভিন্ন এলাকার মানুষও কর্মসংস্থানের খোঁজে ছুটে আসছেন এখানে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের  ডকইয়ার্ডের কাজ করা দক্ষ শ্রমিকরা ও জাহাজ নির্মাণ কন্ট্রাক্টররা আসছেন কাজের সন্ধানে, এতে করে জাহাজ নির্মাণের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তারা ৪০ থেকে ৭০ টাকা ঘণ্টা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। শুধু সন্ধ্যানদী দুই কূলে নয়, এই নদীতে মিশে যাওয়া বড় বড় খালের পাড়ে  সোহাগদল, স্বরুপকাঠি, সুটিয়াকাঠি, পঞ্চবেকি, বয়ারউলা, বরছাকাঠি,নাওয়ারা,ডুবির হাট, ছারছিনা সহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে এই সকল ডকইয়ার্ড,তৈরি হচ্ছে নতুন আধুনিক মানের জাহাজ, পাশাপাশি মেরামত করা হচ্ছে পুরাতন জাহাজগুলো, এ দৃশ্য অবাক করার মতই।

আন্তর্জাতিক নৌ-রুট থাকায় ডকইয়ার্ড গুলো আধুনিকায়ন হয়ে তৈরি করছে উন্নত মানের  ছোট-বড় নানা আকৃতির জাহাজ, লঞ্চ,  ট্রলার, বালুবহনকারী কার্গোসহ প্রায় ১০ ধরনের লোহার তৈরি নৌযান।  এখানে বর্তমানে ৩০ ফুট থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা জাহাজ তৈরি হচ্ছে। বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী সহ দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও ঢাকা, চিটাগাং থেকে লোকজন নেছারাবাদের ডকইয়ার্ডে আসে জাহাজ তৈরির জন্য। ডকইয়ার্ডের ভাড়া ও শ্রমিকের মজুরি কম, নৌযানের গঠন ও আকৃতি সুন্দর হওয়ায় তারা এখানে আসেন বলে জানান জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সাথে জড়িতরা।

নতুন জাহাজ নির্মাণের পাশাপাশি পুরাতন জাহাজও নির্মাণ ও মেরামত করা হয়। খরচ কম হওয়ায় দূর-দূরান্তের লোকজন এখানে ছুটে আসেন তাদের পুরনো জলযানগুলো মেরামত করতে। জাহাজের আকারভেদে জায়গার ভাড়া হিসেবে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক হারে টাকা দিতে হয় ডকইয়ার্ড মালিককে। বর্তমানে উপজেলার দেড় শতাধিক মানুষ জাহাজ নির্মাণ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও জাহাজ নির্মাণের অধিকাংশ ঠিকাদার ঢাকার, গোয়ালন্দ, চিটাগাং শহর বিভিন্ন এলাকার। মূলত এদের নির্মাণশৈলীতে নেছারাবাদের জাহাজ শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। ডর্ক ইর্য়াড নির্মান ঠিকাদার ও এখানে তৈরি জাহাজ মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায় এসব ডর্ক ইয়ার্ডে ১ হাজার টন ধারন ক্ষমতার বড় জাহাজ তৈরি করতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ মাস এবং একটি জাহাজ তৈরি করে ঠিকাদারদের ২ থেকে ৩ লাখ টাকার বেশি  লাভ হয়। নেছারাবাদের ডর্ক ইয়ার্ড থেকে জাহাজ তৈরি করে সন্তুষ্ট জাহাজ মালিকরা।

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজ নির্মান ও মেরামত করতে আসে। ডর্ক ইয়ার্ড মালিকরা আরও জানান জাহাজ নির্মানের কাঁচামাল ঢাকার পোস্তাখোলা, চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী, কুমিরা, সীতাকুন্ডু, কক্সবাজার, সিলেট থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া কিছু কাঁচামাল ও মেশিনপত্র বিদেশ থেকেও আমদানী করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় এইসকল কাঁচামাল এখানে পৌঁছাতে দেরি হয়, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, বিশেষ করে সন্ধ্যা নদীতে ব্রিজ না থাকায় অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ভারি ও দামি মালামাল পরিবহন করতে হয়, নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করে দুই পারের যোগাযোগের ব্যবস্থা করলে ডকইয়ার্ডের জমির আয়তন বাড়বে, সাথে সাথে  এর সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে এবং পরিবহন খরচ কমে যাবে ।

নেছারাবাদের ডকইয়ার্ড শিল্প মালিক সমিতির সাম্পাদক  বলেন, এ শিল্পর জন্য সন্ধ্যা নদীর চর আরও দরকার ও বিদ্যুৎ সরবরাহ চাহিদামতো দিতে হবে, অনেক বড় বড় ডকইয়ার্ডের মালিক নেছারাবাদের জায়গা খুঁজছে ডকইয়ার্ড করার জন্য, তারা আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ তৈরি করতে সক্ষম। এখানকার শ্রমিকরা জানায় তাদের অনেকেরই নৌযান নির্মাণের কোন প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই, তারা আরও বলেন আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নৌযান নির্মাণ করছি।

যদি আমরা জাহাজ নির্মাণের উন্নতমানের প্রশিক্ষণ পাই, তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ তৈরি করতে পারবো।সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসলে এ শিল্পই হতে পারে কোটি কোটি টাকার অন্যতম রাজস্ব আয়ের উৎস।নেছারাবাদ উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বাবু বলেন, সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে সম্ভাবনাময়  জাহাজ শিল্প গড়ে উঠেছে এর ফলে এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে এই শিল্প বিকাশে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করা হবে।স্বরূপকাঠি বিসিক ম্যানেজার হারুন-অর-রশিদ বলেন দীর্ঘ ৬০ বছর নেছারাবাদে বিসিক শিল্প নগরী গড়ে উঠেছে, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার খারাপ  থাকার কারণে এখানে মাঝারি বা বড় কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, এলাকাটির নদীমাতৃক হওয়ায় বেশ কিছু জায়গায় বড় ধরনের জাহাজ শিল্প গড়ে উঠেছে, বিষয়টি অত্র এলাকার এমপি , গণপূর্ত মন্ত্রী  শ ম রেজাউল করিম মহোদয়ের নজরে আছে, জাহাজ শিল্প বিষয়ে বিসিক জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জমি চিহ্নিত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা যায়।

স্থানীয়রা বলেন নেছারাবাদ একটি ব্যবসায়িক এলাকা,এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করে সন্ধ্যা নদীতে একটি ব্রিজ হলে, বিসিক শিল্প নগরীটি চালু হবে, অন্যান্য শিল্পের বিকাশ ঘটবে, তার সাথে সাথে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রসার ঘটবে, কর্মসংস্থান হবে লাখো মানুষের।নেছারাবাদ হয়ে উঠবে দক্ষিণবঙ্গের প্রধান শিল্পাঞ্চল,আমাদের বিশ্বাস শিল্পবান্ধব বর্তমান সরকার আমাদের নিরাশ করবে না।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*