প্রধান মেনু

নদ-নদীর চরে ভাগ্য গড়ছে ভাঙনে নিঃস্ব হাজার হাজার পরিবার

শফিউল আযম, পাবনা থেকে ।।
এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পেটে জেগে ওঠা বালুচরে দরিদ্র কৃষকরা কৃষি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এক সময় ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা-পদ্মা-যমুনা নদী ছিল তাদের দুঃখের কারণ। এখন সেই নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে অভাব দুর করছেন কৃষকরা। অক্লান্ত পরিশ্রমে অসম্ভাবকে সম্ভব করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন নদীভাঙা নিঃস্ব হাজার হাজার পরিবার।

নদীর বুকে জেগে ওঠা বালু চরে ভাগ্য উন্নয়নের স্বপ্নে ফসল বুনে ঘরে তুলে লাভবান হচ্ছেন চরের খেটে খাওয়া মানুষ। ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-যমুনার অসংখ্য বালু চরে এখন শাক-সবজিসহ নানা প্রকারের ফসলের সমারোহ। শাক-সবজি দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে।
ইরিগেশন সাপোর্ট প্রজেক্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড নিয়ার ইষ্টের (ইসপান) প্রণীত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দেশের প্রধান পাঁচটি নদীতে চরের আয়তন প্রায় এক হাজার ৭২২ দশমিক ৮৯ বর্গকিলোমিটার। যা দেশের মোট জমির এক দশমিক ১৬ শতাংশ। এই পরিমান চরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চরভূমি রয়েছে উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় চরের পরিমান ৯৮৭ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটার। পদ্মা অববাহিকায় চরভূমি ৫০৮ দশমিক ২৭ বর্গকিলোমিটার।

মেঘনার উত্তর ও দক্ষিন অববাহিকায় চরের পরিমান ২২৬ দশমিক ৭৫ বর্গকিলোমিটার। এই চর এলাকায় বাস করছে অন্তত সাত লাখ মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে যমুনা নদীর চর এলাকায়। এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ। ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা ও যমুনার বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় চরে গড়ে উঠছে জনবসতি ও গবাদিপশুর ছোট ছোট খামার।
সর্বনাশা ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ভাঙনে ঘর-বাড়ী হরিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। এমন কী অভাব-অনটন ছিল তাদের নিত্যদিনের সাথী। এখন সে চিত্র বদলে গেছে। এইতো কয়েক বছর আগে যেখানে ছিল বালুচর সেই চরে বণ্যায় পলিমাটি জমে এসব চর এখন উর্বর আবাদি জমিতে পরিনত হয়েছে। দীগন্ত বিস্তীর্ণ বালুচরে এখন শোভা পাচ্ছ্ েরকমারি ফসলের সমারোহ। নদীর তলদেশ শুকিয়ে জেগে ওঠে বালুচর। দীর্ঘদিন পরিত্যাক্ত থাকা এসব বালুচরে ফসল ফলানো দুরের কথা, ঘাসও জন্মাাতো না।

অথচ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেই নদীর ছোট-বড় অসংখ্য চরে ফলছে গম, কাাউন, ভূট্রা, বাদাম, মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, গাজর, মরিচ, হলুদ, শসা, সিম, কুমড়াসহ নানা প্রকারের শাক-সবজি চাষ করে ফসল তুলছেন কৃষকরা। চরের বেলে দো-আঁশ মাটিতে ডাল জাতীয় ফসল মাসকালাই, খেসারী, ছোলা প্রচুর পরিমানে আবাদ হচ্ছে। এছাড়া চরে গড়ে উঠছে জনবসতি ও গবাদিপশুর ছোট ছোট খামার। চরের কৃষি বিপ্লবের পাশাপাশি গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠায় সম্ভাবনাময় পদ্মা-যমুনার বুকে জেগে ওঠা এসব চর পাল্টে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির চিত্র।
বর্ষা শেষে ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর ছোট-বড় অসংখ্য চরে গম, কাাউন, ভূট্রা, বাদাম, হলুদ মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, লাউ, গাজর, মরিচ, হলুদ, শসা, সিম, কুমড়াসহ নানা প্রকারের শাক-সবজি। চরের আকার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তা স্থায়ী চরে পরিনত হচ্ছে। জনবসতীহীন দূর্গোম চরে এখন বসেছে প্রাণের মেলা। চরে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই রয়েছে গরু-মহিষ-ছাগলের ছোট ছোট খামার। গবাদি পশুর খামার করে পাল্টে যাচ্ছে চরাঞ্চলের অর্থনীতি। গবাদি পশু লালন পালনে বিপুল সম্ভাবনাময় চর অঞ্চলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করলে সম্ভাবনাটি বাস্তবে রুপ নেবে। অভাব ঘুচবে অভাবী চরবাসীর। উৎপাদন বাড়বে দুধ কিংবা দুগ্ধজাত সামগ্রীর। এতে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটতে পারে চরাঞ্চলে।
সিরাজগঞ্জের চৌহালীর স্থল ইউনিয়নের গোসাইবাড়ি চরের শুকুর ব্যাপারী বলেন, তিন বছর আগে সংসারে অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। কর্মসংস্থান ছিল না। বাধ্য হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে যমুনা চরে এসে নতুন বসতি গড়ি। গরু পালন করে এখন সাবলম্বী। আল্লাহর রহমতে সংসারে কোন অভাব-অনটন নেই।

বর্তমানে চারটি গরু নিয়ে একটি ছোট খামার গড়ে তুলেছি। খাষপুখুরিয়া ইউনিয়নের কোদালিয়াচরের ময়নাল সিকদার, রজব আলী, উমরপুরচরের আবু ছাইদ ও কোরবান আলী জানান, চর এলাকায় খোলমেলা পরিবেশে গবাদিপশু পালন করায় রোগ বালাই কম হয়। পলি মাটির আস্তরনে জেগে ওঠা ঘাস, বিচালি খাইয়ে তারা গবাদিপশু লালন পালন করছে। এজন্য চরে অনেকেই গরু-মহিষ-ছাগলের ছোট ছোট খামার গড়ে তুলছে।
বর্তমানে চরে বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে ভূমিহীন মানুষরা। বাড়ির আঙিনায় মাথা উঁচু করলেই দেখা যায় ফসলের ক্ষেত। চোখ ধাঁধানো বর্ণিল সবুজ ফসলের সরব উপস্থিতির কারণে অনেক কৃষক তাদের গবাদিপশু নিয়ে চরে উপস্থিত হয়েছে।

চরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে একটি করে গো-খামার গড়ে উঠছে। গো-খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় এই সমস্ত কৃষকরা তাদের গবাদিপশু নিয়ে এসেছে চরে। পলি মাটির আস্তরনে জেগে ওঠা ঘাস, বিচালি খাইয়ে তারা গবাদিপশু লালন পালন করছে। এক সময় পদ্মা-যমুনা নদীর পানি ও মাছের প্রাচুর্যতা থাকলেও এখন ক্রমশ তাতে ভাটা পড়েছে।
ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদীর পেটে জেগে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় চর। চরের বালিয়ারীগুলো ক্রমশ আবাদি জমিতে পরিনত হচ্ছে। আর এসব জমিতে এখন আবাদ হচ্ছে গম, কাাউন, ভূট্রা, বাদাম, মিষ্টি আলু, তিল, তিসি, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, লাউ, কুমড়া, গাজরসহ নানা প্রকারের শাক-সবজি নানা অর্থকরী ফসল। একদিন পদ্মা-যমুনা তাদের সব কিছু কেড়ে নিলেও নদীর বুকে চর জেগে উঠায় তারা একে একে আবার জড়ো হয়েছে এসব চরে। যেসব গ্রাম একদিন বিলীন হয়ে গিয়েছিল সেগুলো পূনরায় সেই নামেই নতুন করে গড়ে তুলছে বসতি। তবে বসতি গড়ে উঠলেও চরে বসবাসরত ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তাদের লেখাপড়ার জন্য নেই কোন স্কুল-মাদ্রাসা।

নদীভাঙা অভাবী শত শত পরিবার নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরকে কাজে লাগিয়ে অভাব দুর করছেন। এই সকল পরিবারের নারীরা তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে শাররীক পরিশ্রম করে বিভিন্ন ফসল ফলাচ্ছেন। সেই ফসল বিক্রি করে সফলতা পাচ্ছেন। চলতি মওসুমের শুরুতে ফসল চাষ করে চাষিদের মুখে এখন সাফল্যের হাসির ঝলক। চৌহালীর মিনারদিয়ার চরের কৃষক আতাউল জানান, বালুচরে কোন ফসল ফলানো যাবে এটা স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন বালুচরে ফসল আবাদ করে অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। প্রতি বছরই বাড়ছে চরের পরিধি। সেই সাথে বাড়ছে ফসলের ফলন।

লাভের টাকা হাতে পেয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষকরা।
ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার চর থেকে কোরবানির ঈদের আগে প্রচুর গরু বিক্রি হয়। চরে খামারিরা গবাদিপশু পালন করে বেশি লাভবান হচ্ছেন। কারণ গবাদিপশু পুষতে তাদের বেশি খরচ বহন করতে হয় না। চরের জমিতে রোপণ করা ধানের খড় ও নানান ফসল খেয়ে গবাদিপশুগুলো বড় হচ্ছে। এ কারণেই প্রতিনিয়তই চরাঞ্চলে গবাদিপশুর খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদীর সম্ভাবনাময় চরের কৃষি ও গবাদিপশুর খামার পাল্টে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির চিত্র।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*