প্রধান মেনু

নগরবাড়ী ও বাঘাবাড়ীতে লাখ লাখ বস্তা সার খোলা আকাশের নিচে

শফিউল আযম, পাবনা থেকে ।।
উত্তরাঞ্চলের নগরবাড়ী ও বাঘাবাড়ী নৌবন্দর এলাকায় দেশি বিদেশ লাখ লাখ বস্তা রাসায়নিক সার খোলা আকাশের নিচে অরক্ষিত অবস্থায় ষ্ট্যাক দিয়ে রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন খোলা জায়গায় পড়ে থাকায় রোদে পুড়ে, কুয়াশা ও বৃষ্টিতে ভিজে সারের গুনগতমান কমে যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, প্রতি বস্তা সারের ওজন দুই থেকে তিন কেজি কমে যাচ্ছে। এই সার কিনে কৃষকরা প্রতারিত হচ্ছে বলে ডিলাররা জানিয়েছে। এদিকে মাসের পর মাস ষ্ট্যাক দিয়ে রাখা সারের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।

জানা যায়, বিসিআইসি আমদানীকারকদের মাধ্যমে চীন, মিশর, সৌদি আরব, তিউনিশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরিয়া, ডিএপি, এমওপি ও টিএসপি সার আমদানি করছে। পরে বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে ওই সার বাফার গুদামে পৌঁছে দেয়া হয়। সুমুদ্র পথে বড় জাহাজে সার আমদানি করা হয়। পরে লাইটারেজ জাহাজে সার আনলোড করে বাঘাবাড়ী ও নগরবাড়ী বন্দরে আনা হয়।

সেখান থেকে সড়ক পথে উত্তরাঞ্চলের ১৪টি বাফার গুদামে সার মজুদের জন্য পাঠানো হয়। বাফার গুদামগুলোতে জায়গা না থাকায় বাঘাবাড়ীর বড়াল নদীর উত্তর-দক্ষিণ পাড়ে এবং নগরবাড়ীতে যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ব্যাপী সারের বস্তা ষ্ট্যাক দিয়ে রাখা হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে শুকিয়ে শক্ত ও জমাট বেঁধে সারের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাঘাবাড়ী বন্দরের ট্রান্সপোর্ট এজেন্ট ও বিসিআইসি’র বাঘাবাড়ি বাফার গুদাম সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের পাবনা সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, বগুড়া, শান্তাহার, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, লালমনিহাটের মহেন্দ্রনগর, দিনাজপুর, পার্রতীপুর চরকাট, ঠাকুরগা, বিরামপুর ও গাইবান্ধায় বাফার গুদাম রয়েছে। গত বছরের সারে বাফার গুদামগুলো ভরা রয়েছে।

ফলে বন্দরে যে পরিমান সার আসছে, তা বন্দর এলাকাতেই পড়ে থাকছে। দীর্ঘ দিন পড়ে থাকা সারের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এদিকে সারের ঝাঁঝালো গন্ধে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
বাঘাবাড়ী বন্দরে প্রায় ছয় মাস ধরে লাখ লাখ বস্তা রাসায়নিক সার মাটিতে ষ্ট্যাক দিয়ে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি ও কুয়াশাতে ভিজে রোদে পুড়ে সারের কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বাঘাবাড়ী বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যা চলছে। বাঘাবাড়ীর বড়াল নদীর উত্তর ও দক্ষিন পাড়ের বিভিন্ন স্থানে সারের বড় বড় ষ্ট্যাক পড়ে আছে। বাতাসে ভাসছে সারের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। আশপাশের এলাকায় এই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সারের ঝাঁঝালো গন্ধে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।

নগরবাড়ী বন্দর সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, চট্রগ্রাম নৌবন্দর থেকে প্রায় দুই হাজার টন রাসায়নিক সার বোঝাই পাঁচটি কার্গো জাহাজ নগরবাড়ী নৌবন্দরে এসে নোঙর করেছে। বেশকিছু জাহাজ আনলোডের অপেক্ষায় রয়েছে। জাহাজগুলোর গন্তব্য বাঘাবাড়ী নৌবন্দর হলেও যমুনায় নব্যতা সঙ্কটের কারণে নগরবাড়ীতে ভিড়ছে। এতে নগরবাড়ী বন্দর ফিরে পেয়েছে তার হারানো ঐতিহ্য। এ কারণে বাঘাবাড়ী বন্দরের আমদানি-রফতানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

নিয়মানুযায়ী জাহাজগুলো বন্দরে পৌঁছার পর আনলোড করে সার ট্রাকযোগে বাফার গুদামগুলোতে পৌঁছে দেয়ার কথা। কিন্তু গুদামগুলোতে জায়গা না থাকায় এই সার মাসের পর মাস বন্দরের আশপাশে খোলা জায়গায় পড়ে থাকছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নগরবাড়ী বন্দরে পল্টুন ও জেটি নেই। গড়ে ওঠেনি কোন অবকাঠামো। শ্রমিকরা বাঁশের মাচা বেধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী লোড-আনলোড করছে। পল্টুন না থাকায় জাহাজ নদী পাড়ে ভিড়ছে।

শ্রমিকরা পণ্যসামগ্রী নিয়ে বাঁধের ঢালু দিয়ে ওঠা-নামা এবং মালভর্তী ভারী ট্রাক চলাচল করায় বাঁধের অনেক জায়গায় সিসি ব্লক দেবে ও ধসে গেছে। এতে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি হচ্ছে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র রাজনৈতিক দলের কথা বলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বস্তা প্রতি দশ পয়সা হারে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নগরবাড়ী বন্দরে নোঙর করা এমভি আল আমিন কার্গো জাহাজের চালক কাজী নূর বলেন, চট্রগ্রম বন্দর থেকে আট হাজার বস্তা সার নিয়ে এসে ছয়দিন ধরে বাঘাবাড়ী বন্দরে বসে আছি। সার পরিবহন ঠিকাদাররা বলছেন, খুব শিগগিরই জাহাজ থেকে সার আনলোড করা হবে। অথচ বাফার গুদামে পাঠাতে না পারার কারনে দিনের পর দিন এভাবে বসে থাকতে হচ্ছে।

কয়েকজন সারের ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অনেক দিন ধরে সারের বস্তা বাইরে পড়ে থাকায় সার শক্ত ও জমাট বেঁধে যায়। এতে সারের গুনগত মানের কিছুটা পরিবর্তন হয়। কৃষকরা এই সার নিতে চায় না। কৃষকরা দেশি সার কেনার প্রতি বেশি আগ্রহী। অথচ দেশি সার না দিয়ে চিন থেকে আমদানি করা সার তাদের দেয়া হচ্ছে। তবে ডিলাররা বলছেন, বাফার গুদামের সার জমাট বাধা। এছাড়া প্রতি বস্তায় সার দুই থেকে তিন কেজি করে ওজনে কম পাওয়া যায়। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা সারের বস্তার ওজন বেশি কম। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করে দেখার দাবি জানিয়েছেন।
নগরবাড়ী বন্দরের লোড-আনলোড লেবার সরদার ইছাক আলী শেখ জানিয়েছেন, নগরবাড়ীতে বাফারগুদাম নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় জাহাজ থেকে সার আনলোড করে যমুনা নদীর তীরে খোলা আকাশের নিচে ষ্ট্যাক দিয়ে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা আওলাদ হোসেন বলেছেন, মাসের পর মাস সারগুলো খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। এর তীব্র ঝাঁঝে চলাফেরা দুস্কর হয়ে পড়েছে।

জননী ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার দুলাল দাস বলেন, নগরবাড়ী সরকারি গেজেটভূক্ত নৌবন্দর হলেও এখানে সরকারের নিজস্ব কোন সংরক্ষনাগার নেই। যমুনা নদীতে নব্যতা সঙ্কটের কারণে উত্তরাঞ্চলের জন্য যে পরিমান সার নগরবাড়ী বন্দরে আসে, সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকার নগরবাড়ীতে বাফারগুদাম নির্মাণ করছে।
বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ মসকর আলী জানিয়েছেন, নগরবাড়ী নৌবন্দরে সংরক্ষনাগার না থাকায় রাসায়নিক সার খোলা আকাশের নিচে ষ্ট্যাক দিয়ে রাখা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে এভাবে পড়ে থাকায় সারের কার্যক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। এই সার জমিতে প্রযোগ করে কাঙ্খিত ফলন নাও পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সংশি¬ষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বাঘাবাড়ী ও নগড়বাড়ী বন্দরসহ এ অঞ্চলের ১৪ টি বাফার গুদামে প্রায় এক লাখ টন রাসায়নিক সার মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চায়না থেকে আমদানিকৃত সার রয়েছে। এই সারের গুনগতমান বাংলাদেশের কাফকো ও যমুনা সারের চেয়ে অনেক নিন্মমানের। এই নিন্মমানের সার আমদানি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে এক শ্রেনীর আমদানিকারক, বাফার গুদাম ইনচার্জরা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*