প্রধান মেনু

ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস : কেন সাদ্দাম ইরানে আগ্রাসন চালিয়েছিল?

                                                            পর্ব-১।।

আপনাদের হয়তো জানা আছে, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের এক বছর পর ১৯৮০ সালে দেশটির ওপর ইরাকের মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া হয় এক দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকারের আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ওই যুদ্ধ তিন দশকেরও বেশি সময় আগে শেষ হয়ে গেলেও ওই যুদ্ধ সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহে এখনো ভাটা পড়েনি। নতুন এই ধারাবাহিক আলোচনায় আমরা ইরান-ইরান যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকে বাথ সরকারের সেনাবাহিনী জল, স্থল ও আকাশপথে ইরানের ওপর ব্যাপক আগ্রাসন শুরু করে। ওই আগ্রাসনের কয়েকদিন আগে ইরাকের তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দু’দেশের মধ্যে ১৯৭৫ সালে স্বাক্ষরিত আলজিয়ার্স সীমান্ত চুক্তি ছিঁড়ে ফেলেন। ইরাকি বাহিনী আগ্রাসনের প্রথম প্রহরেই ইরানের রাজধানী তেহরানের পাশাপাশি আহওয়াজ, তাবরিজ, হামেদান ও আবাদান বিমানবন্দরে হামলা চালায়। গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দে খোররামশাহর ও আবাদানের মতো ইরানের সীমান্তবর্তী শহরগুলির মানুষের ঘুম ভাঙে। এভাবে ইরানের ওপর আট বছরের যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়। দেশ প্রতিরক্ষার লক্ষ্যে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সারা ইরানের তরুণ ও যুবকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

ইসলামি ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.) আগ্রাসন অব্যাহত রাখার ব্যাপারে ইরাক সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেন। তিনি বলেন, সাদ্দামের মতো আমেরিকার ক্রীড়নকরা যেন একথা না ভাবে যে, তাদের আগ্রাসনের জবাব আমরা দিতে পারব না। তবে আমরা চেষ্টা করব আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে এবং ইরাকের সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করতে।

ইরাকি বাহিনী যখন এ আগ্রাসন শুরু করে তখন ইরানের নয়া ইসলামি সরকারের বয়স মাত্র ১৯ মাস। তখন ইরানের ভেতরে কয়েক হাজার বছরের পুরনো রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার শেকড় উৎপাটনের কাজ চলছে। এতদিন আমেরিকার পদলেহনের জন্য যে সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হচ্ছে। ইমাম খোমেনীর নির্দেশে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি সবেমাত্র গঠিত হয়েছে।  অর্থাৎ সামরিক দিক দিয়ে কোনো অবস্থাতেই ইরান যুদ্ধ করার অবস্থায় ছিল না। অবশ্য বছরখানেক যেতে না যেতেই ইরানের সেনাবাহিনী ও আইআরজিসি তাদের পূর্ণ শক্তি ফিরে পায় এবং বীর বিক্রমে আগ্রাসন প্রতিহত করে। ইরানের পাল্টা আক্রমণে সাদ্দামের আগ্রাসী বাহিনী বহু ফ্রন্টে পিছু হটে যায়।

ইরানের নয়া ইসলামি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যে আগ্রাসন চালানো হয় তার ফলে উল্টো ইরানি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার হয় এবং ইসলামি সরকারের ভিত শক্তিশালী হয়। গোটা পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের আরব দোসররা একদিকে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে সব ধরনের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে; অন্যদিকে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সমরাস্ত্র আসার সব পথ বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় ইরানি জওয়ানরা ন্যূনতম সমরাস্ত্র ও রসদ নিয়ে ইতিহাসের নজিরবিহীন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আগ্রাসী বাহিনীর হাত থেকে মাতৃভূমি রক্ষা করার লক্ষ্যে হাজার হাজার ইরানি জওয়ান বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন।

ইরানের ইসলামি সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাত করার লক্ষ্যে তৎকালীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল শক্তি যখন ইরাক সরকারের পেছনে ঐক্যবদ্ধ তখন ইরানি জনগণ এককভাবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দেন। যুদ্ধের প্রথম বছরে আগ্রাসী বাহিনী ইরানের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা দখল করে নিলেও দ্বিতীয় বছর থেকে ইরানি সেনাবাহিনী আগ্রাসী সেনাদেরকে সীমান্তের ওপারে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। আট বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের এই বীরত্বগাঁথা ইরানের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে যতগুলো নামকরা সিনেমা নির্মিত হয় তার প্রায় সবগুলো আট বছরের ওই যুদ্ধের কাহিনী অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে।

আট বছরের ওই যুদ্ধে বিশ্বের ৫৮টি দেশ একযোগে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এমনকি বহু দেশ থেকে যুবকরা সরাসরি এসে সাদ্দাম বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে ইরানে যে অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয় তা ইতিহাসে বিরল। এই অসহায়ত্ব ইরানি জওয়ানদের মরিয়া হয়ে আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। গোটা বিশ্বকে বিস্মিত করে ইরানি সেনাবাহিনী যে অকুতোভয় লড়াই করে তার ফলে আট বছরের যুদ্ধ শেষে ইরানকে এক ইঞ্চি ভূমিও হাতছাড়া করতে হয়নি। উল্টো ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে নব্য প্রতিষ্ঠিত সেই ইসলামি সরকারের হাত শক্তিশালী হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে একটি প্রবল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আট বছরের ওই যুদ্ধের প্রভাব কারো অজানা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তখন পর্যন্ত আর কোনো যুদ্ধ এত বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বিগত ৪০০ বছরে ইরানের সঙ্গে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের কয়েক দফা বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। কিন্তু সেসব যুদ্ধের সঙ্গে এবার গোটা বিশ্ব সাদ্দামের মাধ্যমে ইরানের ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তার তুলনা চলে না।

তবে কেন সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাকের বাথ সরকার ইরানে আগ্রাসন চালিয়েছিল তা নিয়ে বহুমুখী জল্পনা রয়েছে। কেউ কেউ সীমান্ত সমস্যার কথা বললেও বেশিরভাগ কৌশলগত বিশ্লেষকের মতে, ইরাক ও ইরানের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ বহু বছরের পুরনো এবং এটি এমন কোনো বিষয় ছিল না যা নিয়ে যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু সাদ্দাম সরকার গোটা ইরান দখল করার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় সীমান্ত বিরোধকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী যাতে এ বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং অন্যান্য দেশের ইসলামি আন্দোলনগুলো যাতে এই বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা না পায় সে লক্ষ্যে ইরানের ওপর ওই যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছিল যার ফলে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দুই পরাশক্তিরই ক্ষতি হয়। কাজেই পরাশক্তিগুলোর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জের ধরে ইরাকের বাথ সরকার ইরানে আগ্রাসন চালায়।#

(পার্সটুডে)






উত্তর দিন

Your email address will not be published. Required fields are marked as *

*